ঢাকা: সুপ্রাচীনকাল থেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কামনা-বাসনা, অদম্য ভোগস্পৃহা, বিকৃত ক্ষুধা ও লালসা মেটাতে এক অভিনব ন্যাক্কারজনক প্রথা চলমান রয়েছে। আরবি শব্দ হারাম (অবৈধ বা নিষিদ্ধ) থেকে বিকৃত হয়ে এর নাম হয়েছে 'হারেম'।
এই হারেমসমূহ ছিলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিবাহবহির্ভূত নারীসম্ভোগের কেন্দ্র। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে সুন্দরী রমণীদের স্বেচ্ছায় কিংবা জোরপূর্বক সংগ্রহ করে হারেমে রাখা হতো রাজার বিকৃত যৌনলালসা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র থেকেও সুন্দরী রমণীদের উপহার হিসেবে পাঠানো হতো কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে।
বৌদ্ধযুগের মৌর্য সম্রাটদের থেকে শুরু করে পালযুগ হয়ে মুঘল সাম্রাজ্য ও সবশেষে ঔপনিবেশিক হিন্দু জমিদারদের আমল পর্যন্ত রাষ্ট্রস্বীকৃত হারেমের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। ভারতবর্ষের মুসলিম সাম্রাজ্যের সম্রাট দি গ্রেট আকবরের হারেমে পাঁচ হাজারের অধিক নারী ছিলো। পৃথিবীতে প্রেমের সম্রাট হিসেবে বিখ্যাত শাহজাহান ছিলেন লাম্পট্যের শীর্ষে অবস্থানকারী, এই বিকৃত মানসিকতার সম্রাট ৬৫ বছর বয়সেও পতিতাপল্লীর এক রমণীকে শাহী হারেমে নিয়ে আসলে সৃষ্ট বিতর্কের জবাবে বলেছিলেন, "মিষ্টান্ন সবসময়ই সুস্বাদু -তা যে দোকানেরই হোক"!
ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট নব্য জমিদার সম্প্রদায়ের অবাধ লাম্পট্য ভারতীয় ইতিহাসের এক লজ্জাজনক অধ্যায়। গরীব প্রজার রক্তচোষা খাজনায় কলকাতা নগরীতে রক্ষিতাদের নিয়ে মৌজমস্তিতে ব্যস্ত থাকতেন জমিদাররা। বাংলাদেশের ভাওয়াল রাজার রোমহর্ষক লাম্পট্য ইতিহাস পাঠকদের এখনও চমকিত করে।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চরিত্র কোনদিনই ফুলের মতো পবিত্র ছিল না। প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতার যৌনজীবন কেবল হাজার বছরের রাজনৈতিক লাম্পট্যের উত্তরাধিকার বহন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন রাষ্ট্রীয় লাম্পট্যকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করে এরশাদ চিরস্মরণীয় হয়েছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বড়-ছোট-মাঝারি নেতৃবৃন্দের চারিত্রিক শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে দেশবাসী তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে দ্বিধাবোধ করবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, হারেম বা রাজনৈতিক লাম্পট্য নিয়ে এত কথা লেখার কারণ কি? কারণ হচ্ছে, লম্পট রাজপুরুষরা রাজকার্য পরিচালনায় হারেমের যৌনসঙ্গী কর্তৃক প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর বর্ধমানের আফগান শাসক শের আফগানকে হত্যা করে তার স্ত্রী মেহেরুন্নিসাকে অপহরণ করে দিল্লীর হারেমে আশ্রয় দেন। এই মেহেরুন্নিসাই পরবর্তীতে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান নাম নিয়ে স্বীয় রূপলাবণ্যে জাহাঙ্গীরের মতো প্রতাপশালী সম্রাটকে পুতুল করে রেখেছিলেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের কর্ত্রীত্ব করেছেন।
কলকাতার বেগমপাড়ার বেশ্যাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাংলার অনেক প্রজাবৎসল জমিদার জমিদারি খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন ও প্রজাদের দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছেন।
আধুনিক উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রাচীন হারেমের উত্তরাধিকার তথা সুন্দরী রমণীদের ভূমিকা ও প্রভাব, দুইই বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ের মিলিটারি একনায়ক ও নীতিহীন লম্পট রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সুন্দরী দুশ্চরিত্রা রমণীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে রাজনীতিতে পাঙ্ক্তেয় করেছেন। এর ভয়াবহ ফলাফল ভোগ করেছে কোটি কোটি নাগরিক।
আজও অধিকাংশ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা দুশ্চরিত্রা রমণী ও কালো টাকার হাতে তুলে দিয়েছেন নিজেদেরকে এবং একইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যকেও! এই সুযোগে দেশব্যাপী একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে, যারা লম্পট রাজপুরুষদের বিছানায় সুন্দরী দুশ্চরিত্রা রমণী সরবরাহ এবং টেবিলের নীচ দিয়ে কালো টাকার বস্তা সরবরাহ করে রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে বসেছে।
নীতিবান দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মী, চরিত্রবান মেধাবী নারীনেত্রী এবং সাধারণ জনগণ এই দালালশ্রেণীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় নাগরিক সুবিধা পেতে হলে এই দালালদের তোষামোদ ও ক্ষেত্রবিশেষে এদের চাহিদা পূরণ করেই রাষ্ট্রনেতাদের সান্নিধ্যে যাওয়া যায়; নতুবা নয়।
আজ দেশব্যাপী যে ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কট বিরাজমান, তার মূলে রয়েছে এই নষ্ট হারেম সংস্কৃতি ও অর্থের অপব্যবহার। রাজপুরুষদের চারিত্রিক স্খলন তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। নারী ও অর্থের সরবরাহকারী দালালরা জননেতা ও জনগণের মাঝে যে ইস্পাতকঠিন দেয়াল সৃষ্টি করেছে -সেই দেয়াল ভেদ করা নিরীহ জনতার কাছে দূরূহ কিন্তু অসম্ভব কিন্তু নয়!
দেশের প্রতিটি সেক্টরে আজ পাপিয়া-সাবরিনাদের দাপট, সম্রাট-সাহেদদের দৌরাত্ম্য সৃষ্টির উৎস কিন্তু লম্পট রাজনীতিকরাই। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ কিসের বিনিময়ে এসব দুশ্চরিত্র-দুশ্চরিত্রাদের হাতে দেশের সর্বময় ক্ষমতা তুলে দিয়েছে, তা জাতির সামনে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে জনগণের কাঁধে চেপে বসা রাজনৈতিক জমিদার, রাজা, সম্রাটদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
দেশব্যাপী গুটিকয়েক হারেমবাসী কিংবা গুটিকয়েক দালাল গ্রেফতার করেই এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। দেশের রাজপুরুষদের চরিত্রে শাণ দিতে হবে -এই শাণ দেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে তরুণ প্রজন্মকে এবং দেশের গণমাধ্যমকে। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী লাম্পট্য থেকে রাজপুরুষদের মুক্ত করতে হবে সর্বাগ্রে -এরপর ধরতে হবে হারেমের দালাল ও কালো টাকা সরবরাহকারী লম্পটদের। রাষ্ট্রকে এই লম্পটদের রক্তসাগরে গঙ্গাস্নান করিয়ে পূতপবিত্র করতে না পারলে মানবজাতি তথা সভ্যতার মুক্তি নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(প্রথম প্রকাশ: দ্য নিউজফ্রন্ট, কলকাতা)
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সাইফুল আলম তুহিন
ইমেইল: news@pratidinermymensingh.com
©সর্বস্বত্ব ২০১৬-২০২৪ | প্রতিদিনের ময়মনসিংহ