
ময়মনসিংহ: নেত্রকোণার হাওরাঞ্চল মদনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নে খাল খননের মাটি অবৈধভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে স্থানীয় একটি চক্র। যে কারণে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। স্থানীয় প্রশাসন মাটি কাটার বিষয় জানার পরও রহস্যজনক কারণে পালন করা হচ্ছে নীরবতা, যেন দেখার কেউ নেই।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের এই নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। অভিযোগের পরেও ব্যবস্থা না নেয়ায় মাটি বিক্রির সাথে প্রশাসনের গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত করছেন ক্ষুব্ধ কৃষকসহ স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা প্রশাসনের যোগসাজসেই লক্ষ লক্ষ টাকার মাটি নিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। এ নিয়ে অভিযোগ করলেও ব্যবস্থা নিচ্ছেনা প্রশাসন। ফলে কোটি কোটি টাকার কাটা মাটি বিক্রি করে লোপাট করছে সরকারি অর্থ। লক্ষ লক্ষ টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
স্থানীয় ও পাউবো সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের পাহারপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মগড়া নদী থেকে হাওরে পানি প্রবাহের জন্য হলহলিয়া খাল খননের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরই প্রেক্ষিতে ৩ কোটি ২ লাখ ১৮ হাজার ৩১৯ টাকা ব্যয়ে ময়মনসিংহের তাজওয়ার ট্রেড লিমিটেড- এম রহমান (জেভি) এন্টারপ্রাইজ কাজটি পায়। খালের খনন কাজের দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৫০০ মিটার, প্রস্থ ১০ মিটার, স্থানভেদে সাবেক গভীরতা ০ থেকে ১ মিটার বা তার কম এবং ওপরের দিকে গড় ১৮-২০ মিটার করা হয়।
প্রথম দফায় ২০২১ সালে খননের একাংশের মাটি স্থানীয় প্রশাসন প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকায় অকশনে বিক্রিও করেন। যা এক সপ্তাহের মধ্যেই ইজারদার নিয়ে নেন। কিন্তু পরবর্তীতে উত্তোলিত মাটি অকশন ছাড়াই বিক্রি করে দিচ্ছে স্থানীয় একটি ব্যবসায়ী চক্র। যাদের সাথে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের ওঠাবসা রয়েছে বলেও স্থানীয়দের কাছে প্রতীয়মান। যে কারণে মাটি বিক্রির বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি উপজেলা প্রশাসন।
গত ২৭ দিনে চোর চক্রের মাটি বিক্রি করা জরিপের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য সূত্র জানায়, গত বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ থেকে নতুন বছরের জানুয়ারি ১৬ তারিখ অবধি প্রায় ২৭ দিন ধরে (চলমান) মাটি তুলে বিক্রি করার বিষয়ে নানা অভিযোগ গেলেও ইউএনও কর্ণপাত করেননি। প্রতিদিন হললিয়া খালের পাড় থেকে আটটি গাড়ি দিয়ে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি গাড়ি দিনে ১৫ থেকে ২০ বার করে মাটি নিয়ে যায়। প্রতি গাড়িতে ৮ শ টাকায় মাটি বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয়দের হিসাবেই প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৬০ গাড়ি মাটি নিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ এই মাটি বিক্রেতারা সিন্ডিকেট করে লোপাট করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকায় খনন করা এই মাটি। যার একদিনের বর্তমান মূল্য ৯৬ হাজার থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। ওই হিসেবে ২৭ দিনে ২৫ লক্ষ ৯২ হাজার থেকে ৩৪ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকার মাটি বিক্রি করেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
গাড়ি ভাড়া করে মাটি বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া মো. এরশাদকে কিভাবে মাটি নিচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, প্রতি গাড়ি ৫ শ থেকে সাড়ে ৫ শ টাকায় নিয়ে যান। তাকে মাটি নেয়ার জন্য হৃদয় দিয়েছে। ইএনও’র কাছ থেকে হৃদয় নিয়েছে, এ বিষয়ে আমি কিছু জানিনা বলেও এরশাদ জানায়।
তিনি আরও জানান, গতবার কাগজ করে এনেছিল। এবার কিভাবে আনছে আর বলতে পারব না। সাথে সঞ্জু ও সিরাজ নামের আরও দুজন আছে বলেও জানান এরশাদ।
এদিকে এমন বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করেছে এমন কোন গোয়েন্দা সংস্থা বা স্থানীয় কৃষক কেউই বাকি নেই। কিন্তু এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে অদৃশ্য কারণে নীরব থাকেন মদনের নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আলম মিয়াকে ফোন দিলে কল ওয়েটিং দেখানোর পর থেমে থেমে ঘন্টাখানেক ফোন দিলেও আর ফোনটি রিসিভ করেননি তিনি।
তবে মুহুর্তেই স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর কল আসে। কলটি রিসিভ করলে তিনি জানান, তিনিসহ আরও কয়েকজন ইউএনওর থেকে মাটিগুলো অকশনে কিনেছিলেন। যাদের জমির ওপর রাখা তারা অভিযোগ দেয়ায় মাটিগুলো সরাচ্ছেন।
অন্যদিকে হলহলিয়া খালের মাটি বিক্রয়কারীদের একজন সিরাজ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ইউএনও স্যারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মাটি বিক্রি করছি। তিনি বলেছেন, লিখিত লাগবেনা আমি বলেছি ওখানে কেউ যাবেনা।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান বলেন, খাল খননের পর মাটিগুলো অকশন দেয় স্থানীয় প্রশাসন। সবটাই তাদের এখতিয়ার। পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনা। তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলবেন বলেও জানান।
এদিকে জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজের সাথে কথা বলে মাটি বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মাটিগুলো কখন কিভাবে কাটা হয়েছে, কারা কেটেছে জানতে চেয়ে পরে বলেন এটি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহীর সাথে কথা বলবেন।